মাওলানা মাসুম আলী গাজী নাজাফী
নাম : ফাতিমা বিনতে হিযাম।
উপনাম : উম্মুল বানীন।
জন্মস্থান : পবিত্র মদিনা।
মৃত্যু / শাহাদাত : ১৩'ই জমাদি আল-সানী।
সমাধিস্থ : পবিত্র মদিনা, জান্নাতুল বাক্বী।
ফাতিমা বিনতে হিযাম, যিনি "উম্মুল বানীন" নামে খ্যাত ছিলেন, তিনি ছিলেন হযরত ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পরে ইমাম আলি (আঃ)-এর অন্যতম স্ত্রী। তিনি শিয়াদের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন। হযরত আলি (আঃ)-এর মাধ্যমে তাঁর চারটি পুত্র সন্তান ছিল, যাঁদের নাম হল, হযরত আব্বাস, আব্দুল্লাহ, জাফর ও উসমান (আঃ)। উল্লেখিত চারজন ইমাম হোসায়েন (আঃ)-এর সাথে পবিত্র কারবালা প্রান্তে শহীদ হন। যেহেতু তিনি চার পুত্রের জননী ছিলেন, তাই তিনি *উম্মুল বানীন* অর্থাৎ পুত্রদের মা নামে খ্যাত হন।
হযরত উম্মুল বানীন (সাঃআঃ)
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পর ইমাম হোসায়েন (আঃ) ও তাঁর পুত্রদের জন্য এমনভাবে আযাদারী ও মাতম করতেন যে, আহলেবায়েত (আঃ)-এর শত্রুরাও তাঁর সাথে কাঁদতে বাধ্য হতো।
বংশ পরম্পরা।
হযরত "উম্মুল বানীন" (ফাতিমা বিনতে হিযাম, বিন খাদিল, বিন রাবীয়া, বিন আমির, বিন সাআসা আল কেলাবীয়া) , বনী কেলাব গোত্রের সম্মানিত কন্যা ছিলেন।[১] তাঁর মায়ের নাম ছিল, লায়লা বা সোমামা বিনতে সোহেল বিন আমির বিন মালিক। [২]
মত্যু তারিখ।
হযরত উম্মুল বানীন (সাঃআঃ)-এর মৃত্যুর সঠিক তারিখ ঐতিহাসিক সূত্রে লিপিবদ্ধ নেই, তবে যা বিখ্যাত তার মাধ্যমে জানা যায় যে, তিনি ১৩'ই জমাদি আল-সানী তে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাক্বীতে দাফন করা হয়।
ইমাম আলি (আঃ)-এর সাথে বিবাহ।
রসূল নন্দিনী হযরত ফাতিমা যাহরা (সাঃআঃ)-এর লোমহর্ষক শাহাদতের কয়েক বছর পর, হযরত আলি তাঁর ভাই আক্বিলের সঙ্গে পরামর্শ করলেন, (যিনি বংশপরম্পরা চিহ্নিত করনে বিখ্যাত ছিলেন) এমন একজন সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে এক স্ত্রী বেছে নেওয়ার বিষয়ে, যিনি একজন সাহসী, পরাক্রমশালী এবং যুদ্ধবাজ সন্তানের জন্ম দেবেন। হযরত আক্বিল ফাতিমা বিনতে হেযামের নাম প্রস্তাব দেন এবং বলেন, বনী কেলাব গোত্রের মানুষের ন্যায় কোন সাহসী ব্যক্তি আরবদের মধ্যে পাওয়া যায় না। এভাবেই হযরত আলি তাঁর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। [৩]
মহান আল্লাহ তাআলা এই বিবাহের ফল, চার পুত্রের রূপে দান করেছিলেন যাদের নাম হল :
হযরত আব্বাস, আবদুল্লাহ, জাফর ও উসমান (আঃ)।
তাঁর এই চার পুত্র সাহসিকতা ও বীরত্বের অনুকরণীয় ছিলেন, তাই তাঁকে *উম্মুল বানীন* বলা হয়। উল্লেখিত তাঁর এই চার পুত্রই কারবালায় তাঁদের অন্তরঙ্গ ভাই ও ইমাম, শহীদ সম্রাট ইমাম হোসায়েন (আঃ)-এর পদতলে শাহাদাতের মহান সম্মান অর্জন করেন।[৪]
কথিত আছে যে, তিনিই (হযরত উম্মুল বানীন) হযরত ইমাম আলিকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, তাঁকে ফাতিমা'র পরিবর্তে *উম্মুল বানীন* বলে ডাকতে, যাতে হযরত ফাতিমা যাহরা (সাঃআঃ)-এর সন্তানদের, তাঁকে ফাতিমা বলে ডাকার ফলে তাঁদের মা, হযরত ফাতিমা যাহরা (সাঃআঃ)-এর কথা মনে না করিয়ে দেয়। আর সেই সাথে তাঁদের মায়ের সাথে সংঘটিত দুঃখজনক ঘটনাগুলি তাঁদেরকে আঘাত না করে।
কারবালার ঘটনার পর হযরত উম্মুল বানীন।
কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার সময় হযরত উম্মুল বানীন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। কারবালার বন্দীদের কাফেলা যখন মদীনায় পৌঁছায়, তখন কেউ তাঁকে তাঁর সন্তানদের শাহাদাতের খবর দেয় কিন্তু তিনি বলেন : ইমাম হোসায়েন সম্পর্কে বল, যখন তাঁকে বলা হয় যে, ইমাম হোসায়েন আপনার চার সন্তানসহ কারবালায় শহীদ হয়েছেন। তখন তিনি বললেনঃ যদি আমার সন্তানসহ যা কিছু যমীন ও আসমানের মধ্যে আছে, সবই আমার হোসায়েন এর জন্য কোরবানি হয়ে যেত এবং তিনি জীবিত থাকতেন। তাঁর এসব বক্তব্য, ইমাম হোসায়েন ও আহলেবায়েত এর প্রতি তাঁর প্রকৃত ও আন্তরিক ভালোবাসা প্রতিফলিত করে।[৫]
ঐতিহাসিক সূত্রে লেখা আছে যে, হযরত যয়নাব (সাঃআঃ) পবিত্র মদিনায় পৌঁছনোর পর *উম্মুল বানীন* এর সাথে সাক্ষাত করতে যান এবং তাঁকে তাঁর পুত্রদের শাহাদাতের জন্য সমবেদনা জানান।[৬]
হযরত উম্মুল বানীন এর নিজের সন্তানদের জন্য শোক পালন করা।
হযরত *উম্মুল বানীন* তাঁর সন্তানদের শাহাদাতের খবর পেয়ে প্রতিদিন নিজের দোহিত্র ওবায়দুল্লাহ (আব্বাসের ছেলে)-কে নিয়ে জান্নাতুল বাক্বী নামক কবরস্থানে যেতেন এবং সেখানে নিজের রচিত শোকগাঁথা আবৃত্তি করতেন। আর সেই সাথে ডুকরে ডুকরে আর্তনাদ করতেন। মদীনার লোকেরাও তাঁর চারপাশে জড়ো হয়ে তাঁর সাথে ক্রন্দন করতেন। এমনকি বলা হয় যে, মারওয়ান ইবনে হেকাম, যে আহলেবায়েত এর চরম শত্রু হিসেবে পরিচিত ছিল, সেও তাঁর সাথে ক্রন্দন ও বিলাপ করতে বাধ্য হতো।[৭]
তিনি হযরত আব্বাস (আঃ)-এর জন্য মর্সিয়ার নিম্নলিখিত এই শোকগাঁথা আবৃত্তি করতেন, যার অনুবাদ হল :
"হে! যারা আব্বাসকে শত্রুর উপরে আক্রমণ করতে দেখেছ, যিঁনি শত্রুদের পিছনে ছিলেন।
তারা বলে যে, আমার ছেলের হাত বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল এবং তার মাথায় বজ্রপাত করা হয়েছিল। তোমার হাতে যদি তরবারি থাকতো তাহলে কে উ তোমার ধারে কাছে আসতো না।"[৮]
তিনি বাগ্মী ও মিষ্টভাষী, সাহিত্যিক, কবি এবং প্রজ্ঞাবান এক মানুষ হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন।[৯]
হযরত উম্মুল বানীন সম্পর্কে মহান মুরুব্বীদের সোনালী উক্তি।
1-যয়নুদ্বীন আ'মিলী, যিনি দ্বিতীয় শহীদ হিসেবে বিখ্যাত, হযরত উম্মুল বানীন (সাঃআঃ)-এর সম্পর্কে বলেন : হযরত উম্মুল বানীন ছিলেন সবচেয়ে জ্ঞানী ও গুণী নারীদের একজন। তিনি নবুওয়াত পরিবারের প্রতি নিজের বিশেষ ভালোবাসা এবং গভীরভাবে তাঁদের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। আর সেই সাথে সর্বদা তাঁদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। নবুওয়াত পরিবারেও তাঁর উচ্চ মর্যাদা ছিল এবং তাঁরাও তাঁকে বিশেষ সম্মান দিতেন। ঈদের দিনগুলোতে তাঁরা তাঁর কাছে উপস্থিত হতেন এবং তাঁর প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতেন।[১০]
2-সাইয়্যেদ মাহমুদ হুসাইনী শাহরুদী (মৃত্যু ১৭'ই শা'বান ১৩৯৪ হিজরী) বলেছেন :
কঠিন সময়ে আমি হযরত আবুল ফজল আব্বাস (আঃ)-এর মা উম্মুল বানীন এর জন্য একশো বার দরুদ শরীফ পাঠ করে তাঁকে হাদিয়া করি, যার ফলে ভালভাবে আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।[১১]
3⃣সাইয়্যেদ মহসিন আমীন আয়ানুশ শিয়া গ্রন্থে লিখেছেন :
হযরত উম্মুল বানীন (সাঃআঃ) একজন উচ্চ ও মিষ্টভাষী কবি ছিলেন এবং এক সম্ভ্রান্ত ও বীর আরব পরিবার থেকে তাঁর সম্পর্ক ছিল। [১২]
4-মক্বাররম বলেছেন : হযরত উম্মুল বানীন (সাঃআঃ)-কে নেককার নারীদের মধ্যে গণ্য করা হতো। তিনি আহলেবায়েত (আঃ)-এর সত্যতা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিলেন এবং তাঁদের প্রেম ও বন্ধুত্বে বিশুদ্ধ ছিলেন। ফলস্বরূপ তাঁরাও তাঁর প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতেন। [১৩]
5-আলী মুহাম্মদ আলী দুখাইল সমসাময়িক আরব লেখক এই মহান মহিলা সম্পর্কে লিখেছেন :
এই মহিলার (উম্মুল বানীন) মহানুভবতা তখনই প্রকাশ পায় যখন তাঁর সন্তানদের শাহাদাতের খবর আসে, তখন তিনি তাতে কোন কর্ণপাত করলেন না বরং ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নিরাপত্তার কথা জিজ্ঞেস করেন। যেন ইমাম হোসায়েন (আঃ) তাঁরই পুত্র, নিজের সন্তানরা নয়। [১৪]
6-ইরাকের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও গবেষক আল্লামা শেখ বাক্বের শরীফ আল-ক্বারাশী (রহঃ) "আব্বাস বিন আলী রায়েদুল কেরামত ওয়াল ফিদা ফিল ইসলাম" নামক নিজের গ্রন্থে তাঁর ফজিলত সম্পর্কে লিখেছেন :
ইতিহাসে এমন দৃশ্য দেখা যায় না যে, কোন নারী তার সতীনের সন্তানদেরকে বিশুদ্ধ ভালোবাসা দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিজের সন্তানদের উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কেবল এই মহীয়সী নারী অর্থাৎ *উম্মুল বানীন* ছাড়া। [১৫]
তথ্যসূত্র
১) তারিখ এ তাবারী, খন্ড ৪ পৃষ্ঠা ১১৮
২) ইবনে এনাবা প্রণীত, উমদাতুত তালিব ফি আনসাবে আবি তালিব, পৃষ্ঠা ৩৫৬ গেফারী, তালীক্বাত বার মাক্কতালে হোসায়েন পৃষ্ঠা ১৭৪..
3) ইবনে এনাবা প্রণীত, উমদাতুত তালিব ফি আনসাবে আবি তালিব, পৃষ্ঠা ৩৫৭...
৪) ইসফাহানী প্রণীত, মাক্বাতিল আত-তালিবীন, পৃষ্ঠা ৮২-৮৪..ইবনে এনাবা প্রণীত, উমদাতুত তালিব ফি আনসাবে আবি তালিব, পৃষ্ঠা ৩৫৬.. হাস্সুন প্রণীত, আ'লাম আল-নিসা 'আল-মুমিনাত, পৃষ্ঠা ৪৯৬..
৫)হাস্সুন প্রণীত আ'লাম আল-নিসা আল-মুমিনাত পৃষ্ঠা ৪৯৬-৪৯৭.. শেখ যাবিহুল্লাহ প্রণীত রিয়াহাইন আল-শরিয়া, খন্ড ৩ পৃষ্ঠা ২৯৩..
৬) মুসাভী প্রণীত, ক্বামার বনী হাশিম, পৃষ্ঠা ১৬..
৭) ইসফাহানী প্রণীত, মাক্বাতিল আল-তালিবীন, পৃষ্ঠা ৮৫..
৮) শেখ যাবিহুল্লাহ প্রণীত রিয়াহাইন আল-শরিয়া, খন্ড ৩ পৃষ্ঠা ২৯৪.. তানক্বীহুল মিক্বাল খন্ড ৩ পৃষ্ঠা ৭০..
৯)হাস্সুন প্রণীত আ'লাম আল-নিসা আল-মুমিনাত, পৃষ্ঠা ৪৯৬-৪৯৭..
১০) সিতারা দারাখশান মদীনা হযরত উম্মুল বানীন, পৃষ্ঠা ৭..
১১) চাহরা দারাখশান ক্বামার বনী হাশিম আবুল ফজল আল-আব্বাস (আঃ), খন্ড ১ পৃষ্ঠা ৪৬৪..
১২) আয়ান আশ শিয়া, খন্ড ৮ পৃষ্ঠা ৩৮৯..
১৩) মুক্বাররাম প্রণীত, আল-আব্বাস (আঃ), পৃষ্ঠা ১৮..
১৪) আহমদ দুখাইল প্রণীত আল-আব্বাস মিনাল বিলাদাত ইলাশ শাহাদৎ, পৃষ্ঠা ১৮..
১৫) বাক্বের শরীফ আল-ক্বারাশী, আব্বাস বিন আলী, পৃষ্ঠা ২৩..
আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মদ ওয়া আ'লে মুহাম্মদ ওয়া আজ্জিল ফারাজাহুম ওয়াহ শুরনা মাআহুম ওয়াল আন আদুওয়াহুম।